মাওলানা সুলতান আহমেদ ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত মিরেরখীল গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ছিলেন একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, ইসলামের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় তাঁর ছিলো প্রখর জ্ঞান। সারা জীবন তিনি সে জ্ঞান মানুষের কাছে বিতরন করে গেছেন। তাঁর পিতার নাম হাজী আফিউদ্দীন মিয়াজী এবং মাতার নাম সৈয়দা গুলফরাজ খাতুন। আম্বিয়া খাতুন নামে তাঁর একটি বোন ছিল। তাঁর পুর্ব পুরুষদের আবাস ছিল হাটহাজারীর ছিপাতলীতে। ১৮শ শতাব্দির মাঝামাঝি তাঁর পিতামহ হাজী আসহাব উদ্দীন মিয়াজী হাটহাজারী হতে ফটিকছড়িতে এসে বসতি স্থাপন করেন।
বাল্য জীবন মাত্র চার বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। স্বামীর অবর্তমানে তাঁর সদ্য-বিধবা মাতা পিতৃহীন দুটি সন্তান নিয়ে অত্যন্ত সঙ্কুল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। প্রতিবেশী কিছু দুষ্টলোক তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া সহ নানাভাবে উত্যক্ত করতে থাকে। শেষ পর্য্যন্ত নিরুপায় হয়ে তাঁর মাতামহ সৈয়দ আবদুস সোবহান তাঁর বিধবা কন্যা গুলফরাজ খাতুনকে কাজিরহাটের পাশের মীর বাড়ির আবদুল হক মীরের সাথে আবার বিয়ে দেন। শর্ত থাকে যে, বিয়ের পর মীর সাহেব হাজী আফিউদ্দীন মিয়াজীর বাড়ি-ভিটায় থেকে তাঁর পুত্র-কন্যা দুটির দেখা শোনা করবেন। পুর্ব থেকে নিঃসন্তান মীর আবদুল হক পরবর্তিতে তাঁর এই দুই সৎ পুত্র-কন্যাকে নিজ জীবনের চাইতেও বেশী ভালোবাসা দিয়ে তাঁর দেয়া কথা রেখেছিলেন। শিক্ষা জীবন একদিন মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে শিশু সুলতান বাড়ির পাশে সড়কের ধারের একটি কুয়া সিঞ্চন করছিলেন। পাশে সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন সর্বজন মান্য ব্যক্তি মাওলানা ফজলুল করিম। তিনি শিশু সুলতানকে দেখে জিজ্ঞেশ করলেন, একি! এটি কি হাজী আফিউদ্দীন মিয়াজীর ছেলে নয়? বাবা তুমি কাদার মাঝে কি করছ? তুমি কি লেখাপড়া করনা? এর কিছুদিন পর তাঁকে কাজিরহাট শরিয়তুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়া হয়। ওই মাদ্রাসায় শিক্ষা শেষ হয়ে গেলে শিক্ষকদের কথামত তিনি ভর্তি হন হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায়। ওই মাদ্রাসায় তিনি ফেকাহ, কালাম, তাফসীর শাস্ত্র এবং হাদিস শাস্ত্রে জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ করেন। শিক্ষার্জনের অব্যবহিত পর তিনি শরিয়তুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। কিছু দিন শিক্ষকতা করার পর তিনি ব্যবসায়ে জড়িয়ে পড়েন। ফকিরহাট স্থাপিত হলে তিনি সেখানে জমি ক্রয় করে দোকান প্রতিষ্টা করেন। তাঁর ছিলো কাপড় আর মুদি-পণ্যের ব্যবসা। ব্যবসায় হাত দিয়ে তিনি অভূতপুর্ব উন্নতি করেন। পারিবারিক জীবন দারুল উলুম মাদ্রাসায় পাঠরত অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয় খায়রুজ্জামান চৌধুরীর প্রথমা কন্যা জারিয়া খাতুনের সাথে। খায়রুজ্জামান চৌধুরীর আর্থিক অবস্থা সচ্চল হবার কারনে চৌধুরী পরিবারের অনেকে এ বিয়েতে রাজি হতে চাননি। খায়রুজ্জামান চৌধুরীর পিতা আবদুল লতিফ চৌধুরী মির্জী পরিবারের সাথে আত্মিয়তা করতে অটল থাকাতে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। জারিয়া খাতুনের গর্ভে মাওলানা সুলতান আহমেদের তিনটি সন্তান জন্ম নিয়ে শৈশবেই মারা যায়। প্রথম ছেলে সন্তান মৃত অবস্থায়ই জন্ম নেয়, দ্বিতীয় কন্যা সন্তান হালিমা দেড় বছর জীবিত থেকে বসন্ত রোগে মারা যায় এবং তৃতীয় ছেলে জন্মের অব্যবহিত পরই মারা যায়। জারিয়া খাতুনের সাথে বিয়ের পাঁচ মাস পর মাথার উপর বটবৃক্ষের ছায়ার মত থাকা সৎ-পিতা আবদুল হক মীর মারা যান। তার পাঁচ বছর পর নশ্বর পার্থিব মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে যান তাঁর মাতা গুলফরাজ খাতুন। দুঃখের ছায়া-তলে কাটতে থাকে তাঁর জীবনের দিনগুলি। ব্যবসায়ে উন্নতির কারনে যথেষ্ট জমি জমা হয় অথচ তা ভোগ করার জন্য কোন সন্তান-সন্ততি ছিলনা। প্রথম বিয়ের তের বছর পর সন্তানের আশা বুকে নিয়ে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন আমতলী মীর বাড়ির মীর আবদুস সালাম মিয়াজীর কন্যা মরিয়ম খাতুনকে। মরিয়ম খাতুনের গর্ভে জন্ম নেয় এক কন্যা, বিবি রহিমা বেগম। আদর আর ভালোবাসার সকল দ্বার খুলে গেল ওই কন্যার পেছনে। কিন্তু অনেক বছর সংসার অতিবাহিত করার পর ও আর কোন সন্তান হয়নি। একটি পুত্র-সন্তানের আকাঙ্খা মনের কোনে সবসময় সখেদে বহন করতে থাকেন। এভাবে বারো বছর পেরিয়ে গেলে পুত্র-সন্তানের আশায় তৃতীয় বার বিয়ে করার মনস্থ করলেন। এবার বিয়ে করেন হরিণা দীঘির আপন মামাত বোন সৈয়দা হাজেরা খাতুনকে। তাঁর মাতা গুলফরাজ খাতুনরা ছিলেন দু’ভাই পাঁচ বোন। হাজেরা খাতুন ভাইয়েদের মধ্যে বড় সৈয়দ হাফেজ আহমদের কন্যা। হাজেরা খাতুনের কোলে জন্ম নেয় এক কন্যা বিবি হামিদা বেগম এবং তিন পুত্র সৈয়দ নূর কামাল উদ্দীন, সৈয়দ নূর জামাল উদ্দীন আর সৈয়দ নূর মঈন উদ্দীন। জীবনের উপার্জিত আর্থিক সম্পদ ভোগের উত্তরসূরীদের পেয়ে জীবনের কিছুটা সার্থকতা খুঁজে পেলেন তিনি। বর্ষাকালে একবার বাড়িতে ডাকাত পড়ে। ডাকাতেরা গোলাগুলি করে এবং অনেক মাল পত্র নিয়ে যায়। সেজন্য পরে তিনি পৈতৃক ভিটা বাড়ি বোন আম্বিয়া খাতুনকে দিয়ে মিরেরখীল জামে মসজিদের পাশে নতুন বাড়ি করেন। কর্ম কান্ড ১৯৬৫ সনে তিনি পবিত্র হজ্জ পালন করেন। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে করাচি, জেদ্দা হয়ে তিনি মক্কা এবং মদিনা শরিফ গমন করেন। সেকালে হাজীরা পানির জাহাজে করে হজ্জে যেতেন। তিনি খুব উচ্চস্থরের চিন্তাশীল এবং দার্শনিক মনের জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। সারা জীবন গ্রামে গ্রামে ওয়াজ নসীহত করে সৎ পথে জীবন নির্বাহ করে গিয়েছেন। যে কোন মাহফিলে তাঁর ওয়াজের কথাগুলো ছিল যথেষ্ট হৃদয়স্পর্শী। শিক্ষার প্রতি ছিলো তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ। ব্যবসার কারনে শরিয়তুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেও গ্রামের মক্তবে শিক্ষাদান কখনো বন্ধ করেন নি। অনেক বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েও গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্টা করেছিলেন। আজকের গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে তাঁর ছিল প্রধান অবদান। কিছুলোক যখন বলতে লাগলেন মাওলানা সাহেব মক্তবে শিক্ষকতা করার পরও মক্তবের জায়গায় বিদ্যালয় গড়েছেন, তখন তিনি স্থানীয় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রজি আহমেদ চৌধুরী সহ মিলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য আলাদা ভবন তৈরি করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। গ্রামের জামে মসজিদটি ছিল মাটির তৈরি। আজীবন তিনি ছিলেন সে মসজিদের মুতাওয়াল্লী। সকলকে সাথে নিয়ে ওই মসজিদকে তিনি বৃহৎ পরিসরে পাকা করেছিলেন। মীরের পুকুরে মসজিদের কোন অংশ ছিলোনা। অজুর ব্যাপারে স্থানীয় কিছু লোক বিরোধীতা করলে তিনি মসজিদের জন্য দান করেন পুকুরের কিছু অংশ। ইন্তেকাল ১৯৯৬ খৃষ্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর ফজরের নামাজ আদায় করে জায়নামাজ রাখতে গিয়ে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যান। শুরুতে দুয়েকটি কথা বলতে পারলেও কিছুক্ষণ পর তাঁর বাকশক্তি রোধ হয়ে যায়। ডাক্তার আসলে পরীক্ষা করে জানান তিনি ষ্ট্রোক করেছেন। দুপুরের দিকে তাঁকে নাজিরহাট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতে ডাক্তাররা জানান, এটা তাঁর শেষ অবস্থা। তাঁর আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। পরে তাঁকে ঘরে নিয়ে আসা হয়। ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৬ তারিখ ভোরে সুব্হে কাজেবের সময় তিনি এই মায়াবী পৃথিবীকে শেষ বারের মত ত্যাগ করে পরপারে না ফেরার দেশে চলে যান। যে মসজিদের মুতাওয়াল্লীয়তে আর ইমামতিতে তাঁর জীবনের দীর্ঘ অংশের ব্যয় হয় তাঁর প্রিয় সেই মিরেরখীল জামে মসজিদের সদর দরজার পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। |